ঢাকা ১৫ই এপ্রিল, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ | ২রা বৈশাখ, ১৪২৮ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:০৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৭, ২০২০
জি. কে. সাদিক|| প্রথমেই বলে রাখি, এই লেখায় গত ৩১ জুলাই মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খাঁনের হত্যাকাণ্ড এবং ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার কিম্বা বন্দুক যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রী হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে কথাগুলো বলা হয়েছে সেগুলোর দায় এই লেখকের। পত্রিকার প্রকাশক কিম্বা সম্পাদক কোনোভাবেই এই লেখার জন্য দায়ি নয়। এই লেখায় সিনহার হত্যাকাণ্ড ও ইতোপূর্বে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা অন্য কোন উপায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেগুলোর প্রসঙ্গও আসবে। এই লেখায় আইন ও সংবিধানেই যে এই হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানোর সুযোগ করে দেয়া আছে এবং এসব হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দায় মুক্তি দেয়ারও যে ব্যবস্থা আছে সে বিষয়গুলোও তুলে আনবো। এই হত্যাকাণ্ডগুলো যে বুর্জোয়া রাষ্ট্র ও তার শাসকগোষ্ঠীর টিকে থাকার জন্য জরুরি সেগুলোও তুলে ধরবো। বলা প্রয়োজন এমন হত্যাকাণ্ড কেবল বাংলাদেশেই নয় পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ঘটে। সেগুলোও পরিবেশ ও স্থানের প্রশ্নে বিভিন্ন কৌশলে বৈধ করে নেয়া হয়। যেমন আমরা ফিলিপাইনে মাদক বিরোধী অভিযানকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ড দেখছি, ভারতে ধর্ষণ, মাদক ও সন্ত্রাস দমনের নামে হত্যাকাণ্ড দেখছি, ইয়োরোপি-আমেরিকার দেশগুলোতে সহিংসতা, সন্ত্রাস ও উগ্রবাদ মোকাবেলার নামে হত্যাকাণ্ড দেখছি। তবে এই লেখায় যে তথ্য ও প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের আলোকে। এই লেখায় রাষ্ট্র বলতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামোকে বুঝানো হয়েছে। প্রত্যেক বার ‘বুর্জোয়া রাষ্ট্র’ না লিখে সহজ করার জন্য রাষ্ট্র শব্দটাই ব্যবহার করা হয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই আইন শৃঙ্খলা রক্ষার নামে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার কিম্বা বাংলায় যাকে বন্দুকযুদ্ধ বলে তা বহুল প্রচলিত একটি হত্যাকাণ্ড। এটা সাধারণ মানুষের কাছে ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলে স্বীকৃত। এমনকি শিক্ষিত সচেতন সমাজেও এটাকে ‘বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড’ বলা হয়। ‘বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড’ বন্ধের জন্য সারা পৃথিবীতেই প্রতিবাদ চলছে। এই প্রতিবাদের আড়ালে আমরা নিজেদের অজ্ঞাতেই রাষ্ট্রকে ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’র প্রতি উৎসাহ জোগাচ্ছি। মানে আমরা রাষ্ট্রকে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে আন্দোলন করছি না; আমরা আন্দোলন করছি ‘বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ড’ বন্ধের জন্য। তার মানে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্র নামে যে সুপ্রিম সংগঠনটি আছে সে চাইলে আইন তৈরি করে কাউকে বিচারের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে অবশেষে হত্যা করতে পারবে এবং সেটা বৈধ হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখা দরকার রাষ্ট্র হচ্ছে, সংখ্যালঘু শাসকগোষ্ঠী ও তাদের অনুসারীদের চরম স্বার্থরক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান। এখানে সংখ্যাঘরিষ্ঠ তথা সাধারণ মানুষের অধিকার ততো টুকুই রক্ষা পায় যে টুকু রক্ষা পেলে শাসকগোষ্ঠী ও তার অনুসারীদের বড় কোনো ক্ষতি হয় না। রাষ্ট্র বরাবরই একটি নিপীড়নকারী সংস্থা। সাধারণ মানুষের ও রাষ্ট্রের সার্বিক নিরাপত্তার কথা বলে সে যে আইন করে দিন শেষে সে আইন শাসকগোষ্ঠীর রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখানে সাধারণ মানুষকে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়কে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে শাসকগোষ্ঠীর জন্য নিরাপত্তার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। মানে তাদের যাবতীয় অবৈধ ও অমানবিক কাজ বৈধ করে নেয়া হয়। সেটা এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার কিম্বা বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করা হলেও বৈধ হয়। একদিকে যেমন রাষ্ট্র আইন করে এই ধরণের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিয়ে থাকে অন্যদিকে সাধারণ মানুষের আন্দোলনে কেবল ‘বিচার বর্হিভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা হচ্ছে সেটার ফলে রাষ্ট্রকে বিচারিক হত্যাকাণ্ডের প্রতি উৎসাহিত করা হচ্ছে এবং সেটাকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে। আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় শাসকগোষ্ঠী এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী মত ও তাদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে এমন যে কোন চিন্তা ও কর্ম তৎপরতাকে দমন করে থাকে।
এই আলোচনাটি মূলত আইনশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে রাষ্টীয় বাহিনীর যে কোন হত্যাকাণ্ডকে রাষ্ট্রীয় আইনেই বৈধতা দেয়ার প্রসঙ্গ নিয়ে। তাই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চরিত্র না বুঝে আলোচনা করলে সেটা অপূর্ণাঙ্গ থেকে যাবে। সে জন্য আমাদের আগে বুঝা দরকার যে আসলে রাষ্ট্র নামে যে সংগঠনটি রয়েছে সেটার প্রকৃতি ও চরিত্র কেমন। উক্ত বিষয়ে ধারণা নিয়ে আলোচনা করলে স্পষ্ট হবে যে রাষ্ট্র নামক সংগঠনের সাথেই হত্যাকাণ্ড ও নিপীড়নের ধারণা যুক্ত রয়েছে। রাষ্ট্র নিয়ে জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্কস ও ফেডরিখ এঙ্গেলস তাদের ‘The Communist Manifest’ (1848)-তে বলেছেন, একশ্রেণি কর্তৃক অপরশ্রেণিকে দমন করার রাজনৈতিক প্রাধিকারই হল রাষ্ট্র। আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁরা বলেছেন, আধুনিক রাষ্ট্রের কাজই হল সমগ্র বুর্জোয়াশ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করা। রাষ্ট্র হল একশ্রেণি কর্তৃক অন্যশ্রেণিকে দমন করার যন্ত্র বিশেষ। আধুনিক রাষ্ট্রের শাসকবৃন্দ হল সমগ্র বুর্জোয়াশ্রেণির সাধারণ কাজকর্ম পরিচালনার একটি কমিটি মাত্র। মার্কস-এঙ্গেলসের মতে, রাষ্ট্র হচ্ছে নিপীড়নের হাতিয়ার। ফরাসি দার্শনিক ও রাষ্ট্রচিন্তক লুই আলথুসের স্বীয় `Ideology and Ideological State Apparatuses’ (1970) প্রবন্ধে রাষ্ট্র সম্পর্কিত আলোচনায় দেখাচ্ছেন যে রাষ্ট্র হচ্ছে, ‘নিপীড়নের হাতিয়ার’ যা সবসময় শাসকশ্রেণির পক্ষেই কাজ করে। আলথুসের এখানে মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাষ্ট্রকে ক্রিটিক করেছেন। তিনি লেখায় মার্কসীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লেনিন ও আন্ত্যোনিও গ্রামসির হাত ধরে আলোচনা উপস্থাপন করেছেন। মার্কসের ছাত্র ও রুশ বিপ্লবের মহান নেতা লেনিন স্বীয় `State and Revolution’ (1917) গ্রন্থে রাষ্ট্রকে ‘দমনমূলক হাতিয়ার’ হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, রাষ্ট্র হচ্ছে একশ্রেণি কর্তৃক অপরশ্রেণিকে পীড়ন করার যন্ত্র। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আর এম ম্যাকাইভারের মতে, ‘বলপ্রয়োগের সঙ্গে রাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। উৎপত্তির মূলে, ক্রমবিকাশে, সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ প্রচেষ্টায় এবং রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ শুধু শেষ ভরসাস্থলই নয়; তা রাষ্ট্রের আদিম নীতিও বটে। বলপ্রয়োগ রাষ্ট্রের বিশিষ্ট অস্ত্রমাত্রই নয়, তার প্রাণ প্রদীপতুল্য।’১
আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাষ্ট্র নামক সংগঠনটি হচ্ছে সুপ্রিম। রাষ্ট্রের সুপ্রিম হওয়ার এই ধারণাটাই এমন যেখানে মানুষ ও সমাজের বিভিন্নমুখী স্বাধীন চিন্তা, কর্ম ও সামষ্টিক উদ্যোগকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে দমন করা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই অপরিহার্য। রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ব্যক্তি ও জীবন সর্বদাই কৃপার পাত্র। যেখানে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে ব্যক্তিকে শরীর ও জীবন সপে দিতে হতে পারে কিম্বা রাষ্ট্র নিজেই তা নিয়ে নিতে পারে- যেটা সম্পূর্ণ বৈধ। এমন কাজের জন্য রাষ্ট্র সংগঠনটি ও তার পরিচালক কমিটি কারো কাছে কখনই দায়বদ্ধ নয়। এটাই তার সুপ্রিমিসি। আমরা যখন প্রতিবাদ করছি যে রাষ্ট্র তথা রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে- যাকে আমরা বলছি ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’, মূলত এই দাবির মাধ্যমে আমরা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিবাদ করলেও রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড তথা রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তির শরীর ও জীবন ধ্বংসের বিষয়টির পুরোপুরি বিপক্ষে দাঁড়াচ্ছি না। বরং আমরা রাষ্ট্রকর্তৃক হত্যাকাণ্ডকেই আইনি প্রক্রিয়ার সম্পন্ন করতে বলছি। যে আইনটি করেছে রাষ্ট্র নামক নিপীড়নকারী সংগঠনের কতিপয় পরিচালকগণ। কথা হচ্ছে আদালতের নির্দেশ থাকলেই কি রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ড বৈধ হয়ে যায়? প্রাচীন গ্রিসে ৫ শতাধিক বিচারকের রায়ে মহামতি সক্রেটিসের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। তখন তারা সঠিক ছিল বলেই তাদের দাবি ছিল। বর্তমানে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে গ্রিসের আদালতের বিচারকরা ভুল। তাহলে আদালত আইনে বলে কাউকে হত্যা করলে সেটা বৈধ হয়ে যায় না। তাই শাসকগোষ্ঠীর রক্ষাকবচ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে হত্যাকাণ্ড কেন অবৈধ হবে না সে প্রশ্নও এখন তুলতে হবে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে আদালতে আইনী প্রক্রিয়াতে হত্যা করলে সেটা বৈধ বলে গণ্য করা হচ্ছে। অন্যদিকে পুলিশ, র্যাব বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিজের হাতে ‘আইন’ তুলে নিয়েছে বলে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডকে ‘বিচার বহির্ভূত’ বলে চিহ্নিত করা হয়। রাষ্ট্রকর্তৃক হত্যাকাণ্ড সেটা যে প্রকারে ও ধরণেরই হোক রাষ্ট্র আইন করেই সেগুলোকে অনুমোদন করে। এই লেখায় আমরা দেখবো যে নিপীড়নের হাতিয়ার রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটায় সেগুলোর সুযোগ আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে বলেই এমন হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে।
এক্ষণে আমরা দেখবো যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ড এবং ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার কিম্বা বাংলায় বন্দুক যুদ্ধে যাদের হত্যা করা হয় সেগুলোর পিছনে সাংবিধানিক ও আইনী সুযোগ রয়েছে। যার ফলে এই হত্যাকাণ্ডগুলো খুব সহজেই ঘটে এবং শত প্রতিবাদ, নিন্দা ও আন্দোলন সত্ত্বেও এসব হত্যাকাণ্ড কখনও বন্ধ হয়নি। এমনকি আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও সুফল মিলছে না। কারণ এসব রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের সুযোগ সংবিধান, ফৌজদারী দণ্ডবিধি ও ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ অংশের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ সংবিধানের এই অংশে স্পষ্ট রাষ্ট্র ‘আইনানুযায়ী’ ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও জীবন হরণের ক্ষমতা রাখে। তার মানে ব্যক্তির স্বাধীনতা ও জীবন রাষ্ট্রের আইনের উপর নির্ভর করছে। আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে বেঁচে থাকার অধিকার ‘আইন সাপেক্ষ’। অন্যদিকে সংবিধানের তৃতীয় ভাগেরই ‘গ্রেপ্তার ও আটক সম্পর্কে রক্ষাকবচ’ অংশের ৩৩ অনুচ্ছেদ এর ১ নং ধারায় গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে যথাসম্ভব দ্রুত সময়ের মধ্যে গ্রেফতারের কারণ বর্ণনা, কোনো ধরণের প্রহার না করা, এবং তাকে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। একই অনুচ্ছেদের ২ নং ধারার ‘গ্রেফতারকৃত ও প্রহরায় আটক’ ব্যক্তিকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে হাজির করতে বলা হয়েছে। এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ বাদে তাকে আটকরা না রাখার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর পরেই এই অনুচ্ছেদেরই ৩ নং ধারায় উপরের ১ ও ২ নং ধারাকে ৩ নং ধারা ‘ক’ ও ‘খ’ উপ-ধারার বলে রহিত করা হয়েছে। ‘ক’ উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘যিনি বর্তমান সময়ের জন্য বিদেশী শত্রু, অথবা (খ) ‘যাঁহাকে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান-সংবলিত কোন আইনের অধীন গ্রেপ্তার করা হইয়াছে বা আটক করা হইয়াছে।’ তার মানে বিদেশী শত্রু কিম্বা ‘নিবর্তনমূলক’ আইনে আটককৃত ব্যক্তির ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে উপস্থিত করা, আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার সুযোগ আর রইলো না। এমনকি তাকে প্রহার বা নির্যাতন করাও যাবে। আর এর ফলে যদি সেই ব্যক্তি মারাও যায় তাহলে তারও দায়মুক্তি আছে। বেঁচে থাকার অধিকারকে ‘আইন সাপেক্ষ’ করে দিয়ে সেটাকে আবার বৈধতাও দেয়া ও পুলিশের হাতে কেউ নিহত হলে সেটার দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে হয়েছে সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে। এই অনুচ্ছেদটিই মূলত রাষ্ট্রীয় বাহিনীতে ‘দায়মুক্তি-বিধানের ক্ষমতা’ দিয়ে করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বলা হয়েছে, ‘এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলীতে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তি জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে কোন অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোন কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ঐ অঞ্চলে প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ, দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্য কোন কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন।’ সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদ মতে এটা স্পষ্ট হলো যে নাগরিকদের বেঁচে থাকার অধিকার একটি ‘আইন সাপেক্ষ’ বিষয় এবং ৩৩ অনুচ্ছেদ ও উপ-ধারাগুলো থেকে আইনী সহায়তা ও বিচার প্রাপ্তির বিষয়টি কীভাবে হরণ করা হয় সেটাও স্পষ্ট হলো। এবং যে কোন ধরণের হত্যাকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীকেও দায়মুক্তি দেয়া হলো ৪৬ অনুচ্ছেদে। এরকম দায়মুক্তির জন্য কখনও কখনও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেও হত্যাকাণ্ডের অপরাধ থেকে রাষ্টীয় রাহিনীকে মুক্তি দেয়ার নজির রয়েছে। এই কৌশল ব্যবহার করেই ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে খুনিদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল। রাষ্ট্রী আইন এভাবেই মানুষকে ‘আইনের শাসনের’ নিশ্চয়তা প্রদান করে আবার আইন করেই সেই নিশ্চয়তা অনিশ্চিত করে।
উপরোক্ত অনুচ্ছেদগুলোয় প্রজাতন্ত্রের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তিদের তথা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’, ‘শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে’ যে কারো বিরুদ্ধে যে কোন ধরণের ব্যবস্থা নেয়ার বৈধতা দিয়েছে। সেটা হতে পারে ক্রসফারায়, এনকাউন্টার, বন্দুকযুদ্ধ কিম্বা পিটিয়ে বা অন্য কোন উপায়ে নির্যাতন করে হত্যা। রাষ্ট্রের সুপ্রিম ‘ল’ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদ মতে, উপরোক্ত কারণগুলো দেখিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেগুলো কোনো অপরাধ নয় এবং এর জন্য তাদেরকে কোনো ধরণের বিচার কিম্বা শাস্তির মুখোমুখী হতে হবে না। মানে একটি দেশের সুপ্রিম ‘ল’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হত্যাকাণ্ডের সুযোগ করে দিচ্ছে।
সংবিধানে মতে পুলিশ বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জন্য প্রণিত রেগুলেশন অ্যাক্ট, পুলিশ আইন, পেনাল কোড ইত্যাদি বিষয়গুলো ‘আইন’। এই আইন বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সংবিধানেরই ‘অংশ’। বাংলাদেশের ফৌজধারী কার্যবিধির (১৮৯৮) ৪৬ ধারায় কাউকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে পুলিশে আচরণ বিধির বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধারায় কাউকে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে পুলিশের কার্য ক্ষমতার ও পদ্ধতির দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ এর ১ থেকে ৩ নং উপ-ধারা পর্যন্ত গ্রেফতারের পদ্ধতি সম্পর্কে বলা হয়েছে। ১ নং উপ-ধারা মতে, কোন একটি গ্রেফতার করতে, গ্রেফতারকারী পুলিশ কর্মচারী বা অন্য ব্যক্তি, যাকে গ্রেফতার করবেন সেই ব্যক্তির প্রকৃতপক্ষে দেহ স্পর্শ করবেন বা বন্দী করবেন যদি না সে কথায় বা কাজে আত্মসমর্পণ করে কয়েদ স্বীকার করে। ২ নং উপ-ধারায় অনুযায়ী, গ্রেফতারে বাধা প্রদান করলে বা গ্রেফতার এড়াতে চেষ্টা করলে পুলিশ কর্মকর্তা বা অন্য ব্যাক্তি গ্রেফতার কার্যকর করার লক্ষে প্রয়োজনীয় সকল পন্থা অবলম্বন করতে পারবেন। কার্যবিধির ৪৬ ধারার ৩ নং উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই ধারার কোন কিছুই কোন মানুষকে হত্যার অধিকার দেয় না যদি না সে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে এমন কোন মামলায় অভিযুক্ত না হয়।’ ফৌজাদরী কার্যবিধির এই ধারা, কোন ব্যক্তিকে গ্রেফতার কারা জন্য পুলিশের কোন কাজকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। এই ধারা মতে যদি কোন ব্যক্তি যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মতো মামলায় অভিযুক্ত হয় তাহলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী তাকে হত্যা করতে পারবে। এখান থেকে স্পষ্ট হচ্ছে যে, পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে গিয়ে যে অত্যাচার করে তা বৈধ। এবং ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার কিম্বা বন্দুকযুদ্ধের ফলে যে হত্যাকাণ্ড হয় সেগুলোও আইনে অনুমোদিত। এজন্য পুলিশকে বিচারের মুখোমুখীও হতে হবে না। এখন কথা হচ্ছে একজন ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজার উপযুক্ত কি না সেটা সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে পুরো বিচারিক প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই কীভাবে নির্ধারিত হবে? আর একজন মানুষ যত বড় অপরাধীই হোক না কেন তাকে তো আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এই আইনে স্পষ্ট সে অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়েছে। অথচ এই আইন কেবল সন্দেহের উপর ভিত্তি করে পুলিশের হাতে মেরে ফেলার বৈধতা দেয়া হচ্ছে। হয়তো হত্যাকাণ্ডের শিকার একজন ব্যক্তি নামে একাধিক মামলা রয়েছে। আদালতে যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ায় সে খালাস পেতে পারে। এমন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে গিয়ে পুলিশ যদি তাকে মেরে ফেলে সেটা উক্ত ফৌজদারি আইনে কোনো অপরাধ নয়। মানে এখানে রাষ্ট্র আইন করে স্বীয় বাহিনীকে হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে মুক্তি দিচ্ছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ আমলে ১৮৬০ সালে প্রণিত দণ্ডবিধির ৪ অধ্যায়ের ৭৬ ধারায় পুলিশ তথা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে বিশেষ পরিস্থিতিতে চালানো হত্যাকাণ্ড থেকে যে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে সেটা আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে। ৭৬ ধারার ‘ক’ নং উপ-ধারায় বলা হয়েছে, ‘একজন সৈন্য যদি তার ঊর্ধতন কর্মকর্তার আইনানুগ নির্দেশে একটি জনসমাবেশে গুলি চালায়, তবে তা সৈন্যটির অপরাধ হবে না।’ এই ধারার পূর্বেই পূর্ণ দায়মুক্তির ব্যবস্থা করে ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কেউ যদি এমন কিছু করে যা করার জন্য সে আইনত বাধ্য অথবা সে ভুলবশত সরলমনে বিশ্বাস করে যে এটা করা তার দায়িত্ব তবে তা কোনো অপরাধ হবে না।’ মানে এই ধারায় পুলিশ যদি সন্দেহের ভিত্তিতে ‘শৃঙ্খলা রক্ষার্থে’ ‘সরল বিশ্বাসে’ গুলি চালায় সেটা আইনত ‘বৈধ’। এমনকি সেটা যদি যৌক্তিক নাগরিক আন্দোলনও হয় তবুও পুলিশ গুলি চালিয়ে কাউকে হত্যা করলে সেটা থেকে পার পেয়ে যাবে। তার মানে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যে নিরাপদে নাগরিকদের জন সমাবেশ ও প্রতিবাদের অধিকার দিচ্ছে তা নিরাপদ থাকবে কিনা সেটাও নির্ভর করছে পুলিশ আসলে কী করবে তার উপর।
২০০৯ সালে প্রণিত (১১ জুন ২০০৮ থেকে কার্যকর) ‘সন্ত্রাস বিরোধী আইন’কে (Anti Terrorism Act) ২০১৩ সালে সংশোধন করে সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেবল সন্দেহের ভিত্তিতেই যে কাউকে চাইলে গ্রেফতার, আটক, রিমান্ড এমনকি শাস্তি দেয়ার মতো ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। দিতে পারে। এমন আইন মূলত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার কিম্বা বন্দুকযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যার জন্য ‘রাষ্ট্রীয় সনদ’ প্রদানের মতো। কারণ এখানে হত্যাকাণ্ডের মূলে থাকবে জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার মতো অজুহাত। আর রাষ্ট্র এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে গিয়ে যে কোন ধরণের হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দেয়। যা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের পর রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় সেগুলোতে উপরে বর্ণিত হত্যাকাণ্ডের বৈধতাকারী যে আইনগুলোর কথা উল্লেখ করা হলো সে আলোকেই দিয়ে থাকে। যার ফলে খুব সহজেই তারা দায়মুক্তি পেয়ে যায়।
এ পর্যায়ে আমরা পুলিশ, র্যাবসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো কাউকে ক্রসফায়ারা, এনকাউন্টার কিম্বা বন্দুকযুদ্ধের নামে হত্যা করার পরে যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে দেয় সে বিষয়ে দুটি কেইসস্টাডি থেকে উপরে প্রদত্ত আলোচনার সত্যতা মিলিয়ে দেখবো। দুটি কেইসস্টাডি দুই দলের- বিএনপি ও আওয়ামী লীগের, শাসনামল থেকে তুলে ধরা হলো। দু’দলের আমলের দু’টা কেইসস্টাডি তুলে ধরার ফলে এটা বুঝতে সহজ হবে যে, বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে দলই ক্ষমতায় আসুক রাষ্ট্র কাঠামোর আইন একইভাবে কাজ করে। তার উদ্দেশ্যই শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা। প্রথম কেইসস্টাডি২ হচ্ছে ২০০৫ সালের সাতক্ষীরার একটি ক্রসফায়ারের ঘটনা। সেখানে পুলিশের সাথে ক্রসফায়ারে কার্তিক ঋষি নামক এক ব্যক্তি অস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়। সে ঘটনায় প্রস বিজ্ঞপ্তি হচ্ছে : ‘গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গতকাল দুপুরে তালা থানার পুলিশ তালার আমানুল্লাপুর গ্রামের অমূল্য ঋষির ছেলে কার্তিক ঋষিকে (৩৫) বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তার বিরুদ্ধে তালা থানায় ৫টি হত্যাসহ ১১টি মামলা রয়েছে। পুলিশ তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাতে তালা উপজেলার জিয়ালা নলতা এলাকায় অস্ত্র উদ্ধার করতে যায়। রাত ৩টার সময় সেখানে পূর্ব থেকে ওতপেতে থাকা সন্ত্রাসীরা কার্তিক ঋষিকে ছাড়িয়ে নিতে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে কার্তিক ঋষি নিহত হয় এবং পুলিশের নায়েক হুমায়ুন কবীর ও কনস্টেবল জাহাঙ্গীর হোসেন আহত হয়। সন্ত্রাসীরা ৪০ রাউন্ড এবং পুলিশ ১৫ রাউন্ড গুলি ছোড়ে বলে ওসি জানিয়েছে। ঘটনাস্থলে সন্ত্রাসীদের ফেলে যাওয়া ১টি পাইপগান, ১টি বন্দুক ও ৩ রাউন্ড গুলি পুলিশ উদ্ধার করেছে।৩
দ্বিতীয় কেইসস্টাডি হচ্ছে, গত ০৩ আগস্টে সিলেটের জকিগঞ্জে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে আবদুল মান্নান ওরফে মুন্না আহমদ (৩৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনা। উক্ত ঘটনায় সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) মো. লুৎফর রহমানের সংবাদভাষ্য ছিল নিম্নরূপ : ‘সিলেটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (জকিগঞ্জ সার্কেল) সুদীপ্ত রায়ের নেতৃত্বে মাদক চোরাচালান ও বিভিন্ন মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি আবদুল মান্নানকে গতকাল রাতে আটক করা হয়। পরে রাতেই তাঁকে নিয়ে মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য অভিযান চালায় পুলিশ। রাত সাড়ে তিনটার দিকে সুলতানপুরের অজোগ্রামে অভিযানকালে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। এ সময় পুলিশও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি চালায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে আবদুল মান্নানকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে জকিগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। অভিযানে অংশ নেওয়া সাত পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। তাঁদের জকিগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ৮০০ ইয়াবা বড়ি, একটি দেশীয় পাইপগান, পাঁচটি গুলির খোসা, চারটি রামদা উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। আবদুল মান্নানের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য সিলেটের এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়েছে।’৪
উপরোক্ত কেইসস্টাডি দুটি থেকে সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে যে ‘শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে’ প্রজাতন্ত্রের কার্মরত ব্যক্তি কোন বিষয়ে যে কোন কার্য করার যে অধিকার দেয়া হয়েছে সেটারই প্রমাণ। অন্যদিকে ২০১৩ সালে সংশোধিত ‘Anti Terrorism Act’ অনুযায়ী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে শুধু মাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে যে কাউকে চাইলেই গ্রেফতার, আটক, রিমান্ড এমনকি শাস্তি দেয়ার যে অধিকার দেয়া হয়েছে সেটারই প্রমাণ। এবং ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৬ ধারায় যা বলা হয়েছে সে অনুযায়ীই উক্ত হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটানো হয়েছে। আমরা এবার মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকাণ্ডটি উপরোক্ত আইনী ধারাগুলোর সাথে মিলিয়ে দেখবো।
গত ৩১ জুলাই রাত ৯টায় টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা মো. রাশেদ খাঁন। এই ঘটনায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সিনহার সঙ্গে থাকা সিফাত নামে এক যুবকের ভাষ্য দিয়ে বলা হয়েছে, ‘কোনোরূপ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মেজর (অব.) সিনহার বুকে একে একে তিনটি গুলি ছোড়েন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী।’ অন্যদিকে টেকনাফ মডেল থানায় পুলিশের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘সিনহা মো. রাশেদ হঠাৎ করে তাঁর কোমরের ডান পাশ থেকে পিস্তল বের করে গুলি করার জন্য উদ্যত হলে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ লিয়াকত আলী নিজের এবং সঙ্গে থাকা অফিসার ফোর্সদের জানমাল রক্ষার জন্য চারটি গুলি করেন।’৫ অর্থাৎ পুলিশের ভাষ্যে সিনহাকে গুলি করার কারণ হচ্ছে পুলিশকে দেয়া ২০১৩ সালের সংশোধিত ‘Anti Terrorism Act’ আইনটি এবং নিজের জীবন রক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য যে কোন পদক্ষেপ নেয়া যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেটারই প্রয়োগ। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ৪৬ ধারাও এখানে প্রয়োগ হয়েছে। তাই সিনহা হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এই সুযোগ পুলিশের ও রাষ্ট্রের প্রদত্ত আইনেই রয়েছে। যে আইনী সুযোগের ফলে ইতোপূর্বে কক্সবাজারের টেকনাফে এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযানে ২০১৮ সালের মে মাস থেকে পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ ১৬১ জন নিহত হয়েছে।৬ বেশির ভাগ ঘটনাই মেরিন ড্রাইভ এলাকায় ঘটে। আর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে মাদক ও সন্ত্রাস নির্মূল ও ‘শৃঙ্খলা রক্ষার’ নামে। যেটার সুযোগ দেয়া হয়েছে সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদে।
বুর্জোয়া রাষ্ট্রের চরিত্র ও প্রকৃতি এবং রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীয় বাহিনীকে সাংবিধানিকভাবে ও আইন করে যে সর্বময় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে সেই ক্ষমতাই মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়ার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী সুযোগ। উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা প্রতিয়মান, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালায় সেটা রাষ্ট্রের চরিত্র ও রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রকৃতি থেকেই স্পষ্ট। কারণ বুর্জোয়া রাষ্ট্র মাত্রই শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী। আর সেটা নিশ্চিত করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে সব কিছু করতে পারে। রাষ্ট্রই তাদের এসব ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়ে রেখেছে। যার ফলে এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বুর্জোয়া সমাজের মানবাধিকরা সংস্থাগুলোর আপত্তি, বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের আপত্তি, আদালতের নির্দেশনাসহ কোনো কিছুই রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে হত্যাকাণ্ড থেকে বিরত রাখতে পারছে না। সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয় সেগুলোরও কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। বরং তারা এগুলোকেও দমন করে। বুর্জোয়া রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো ও শাসকগোষ্ঠী পরস্পরের প্রতি তাদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো যেমন শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার জন্য যে কোন ধরণের পদক্ষে নেয়- তা যতো নিমর্ম ও জনস্বার্থ বিরোধী হোক না কেন। অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠী আইন করে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সব কাজের বৈধতা প্রদান করে। এবং এটা সবসময় প্রত্যেক দলের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। উদাহরণ হিসেবে আমরা কক্সবাজারের টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে এলাকাটিতে গত দু’বছরে ১৬১ জনকে ক্রসফায়ার দেয়ার ঘটনাটি দেখতে পারি। সংবাদমাধ্যমের তথ্য বলছে, তারা মাদক দিয়ে ফাঁসি দেয়া এবং ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় করতো। মাদক সন্ত্রাস দমনের নামে এলাকাটিকে তারা ‘ক্রসফায়ার জোন’ করে ফেলেছে। তথাপি ইয়াবার কারবার থামাতে পারেনি।৭ এই দু’জন পুলিশ কর্মকর্তার এই হত্যাকাণ্ড ও ইয়াবা কারবারি বন্ধের নামে সাধারণ মানুষদের নির্যাতন ও অর্থ লেনদেনের তথ্য নিশ্চয়ই রাষ্ট্রী গোয়েন্দা বাহিনীর কাছে রয়েছে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এখন যে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তোড়জোর চলছে সেটা জনগণের সামনে তথ্য প্রকাশিত হয়ে যাওয়ার ফলে রাষ্ট্র তার প্রলেপ দেয়া চরিত্র রক্ষা করতেই ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু চূড়ান্ত ফয়সালা কী হতে পারে সেটা আমরা জানি না। তবে অতীত ঘটনা আমাদের এই আশ্বাস দেয় না যে এর জন্য তাদের চরম মূল্য দিতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটা সময়ই বলে দিবে। এভাবেই যে কোন বুর্জোয়া রাষ্ট্রে শাসকগোষ্ঠী ও রাষ্ট্রীয় বাহিনী উভয়েই পরস্পরের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর থাকে। এমন হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা কমিটি জ্ঞাত থাকার পরও কোনো ব্যবস্থা নিবে না। এটা বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থারই একটা অংশ। আমরা ২০০৪ সালের ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলার ঘটনা ও তার বিচার প্রক্রিয়া থেকেও দৃষ্টান্ত নিতে পারি।
তাই সিনহাদের হত্যাকাণ্ডের জন্য পুলিশ দায়ি নয় মূল দায়ি এই বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যে রাষ্ট্র ‘আইন সাপেক্ষে’ বাঁচার অধিকার দিয়েছে এবং ‘শৃঙ্খলা রক্ষার’ বা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য যে কাউকে হত্যার আইনী সুযোগ রেখেছে। তাই আমাদের আন্দোলন ‘বিচার বির্হভূত হত্যাকাণ্ডের’ বিরুদ্ধে নয় বরং যে ব্যবস্থার মানুষ হত্যা করার আইনী সুযোগ রেখেছে সেই ব্যবস্থা বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। এবং এই অমানবিক বুর্জোয়া রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে দিয়ে মানবিক মর্যাদার, সাম্যের ও সামাজিক ন্যায় বিচারের সমাজ গঠনের জন্য কাজ করতে হবে।
লেখক : জি. কে. সাদিক
কলাম লেখক, কুষ্টিয়া।
তথ্য সূত্র :
১. আর এম ম্যাকাইভার, আধুনিক রাষ্ট্র, অনুবাদ এমাজউদ্দিন আহমদ, সময় প্রকাশনী, ২০০১।
২.https://www.auraj.net/%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%B8%E0%A6%AB%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%86%E0%A6%87%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%AD%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BF/?fbclid=IwAR3dHTFMjMWt4ACh5Xo731xqMBCWo65TcKladm8VUAqcY15w3LwsTFZNEGk
৩. ‘ক্রসফায়ার রাষ্ট্রের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড’, নেসার আহমদ সম্পাদিত- ঐতিহ্য, ২০০৯।
৪. https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1672485/
৫. www.prothomalo.com/bangladesh/article/1672586
৬. https://www.thedailycampus.com/crime-and-discipline/50324?
উপদেষ্টা সম্পাদক: আব্দুল গাফফার
সম্পাদক: মাসুম আল মাহদী
নির্বাহী সম্পাদক: আব্দুল্লাহ সালমান
অফিস: ৩য় তলা রংমহল টাওয়ার, বন্দরবাজার
ইমেইল: info@gmail.com
ফোন: 0088017000000
Design and developed by ITPolly.Com